আপনার প্রতিষ্ঠান এর বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন 01839920911


বৈদিক যুগ থেকে উপাসি

 বৈদিক যুগ থেকে উপাসি


শুক্লযজুর্বেদ সংহিতার ষোলতম অধ্যায়টি পুরোটাই রুদ্ররূপী, শিবরূপী পরমব্রহ্মের স্তোত্র দিয়েই পূর্ণ। সমাজের প্রত্যেকটি শ্রেণী এবং পেশার মানবের মাঝেই রুদ্ররূপ ব্রহ্মের প্রকাশ। ষোলতম অধ্যায়ে গুরুজন, বালক, তরুণ, গর্ভস্থ শিশু, পিতা, মাতা ও সকল আপনজনদের ভগবান রুদ্রের কাছে রক্ষা করার প্রার্থনা করা হয়েছে অনন্য অসাধারণ কাব্যময়তায়। ব্রহ্মরূপী রুদ্রই বৃক্ষ-লতা-গুল্মরূপে, জীবের পালকরূপে, সন্ন্যাসী, সাধু-সন্ত থেকে চোর, বাটপাড়, ছিনতাইকারী সকলরূপে এক তিনিই বিরাজিত। কারণ তিনি ছাড়া যে জগতে আর দ্বিতীয় কেউ নেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়: "দেবাধিদেব মহাদেব! অসীম সম্পদ, অসীম মহিমা ॥ মহাসভা তব অনন্ত আকাশে। কোটি কণ্ঠ গাহে জয় জয় জয় হে ॥" আমরা আজ কথায় কথায় নিজদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতায় অবলীলায় বলে ফেলি যে, বেদে কোন দেবতা প্রসঙ্গে বলা নেই। কিন্তু কথাটি সত্য তো নয়ই; বরং সর্বাংশে মিথ্যা। বেদের আরণ্যক অংশের প্রায় পুরোটা উপাসনাবিধি নিয়েই রচিত। বেদের প্রায় সকল ভাষ্যকার বা ব্যাখ্যাকারই আরণ্যককে বেদ বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন; একমাত্র স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী ছাড়া। এ কথার রেশ ধরে বলতে হয়, যদি শুধু স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর কথাই একমাত্র সত্য হয় তবে পূর্ববর্তী সকল প্রাতঃস্মরণীয় বেদভাষ্যকারদের বাক্যই অসত্য হয়ে যায়। আমাদের উচিত পরম্পরাগত বেদভাষ্যকার এবং তাঁদের সিদ্ধান্ততে যথাসম্ভব অনুসরণ করা। বর্তমানে আমরা ভগবান শিবের অভিষেক এবং সকল রোগনাশের জন্যে "এ্যম্বকং যজামহে সুগন্ধিং পুষ্টিবর্ধনম" মন্ত্র এবং শিবের
জন্যে "এ্যম্বকং যজামহে সুগন্ধিং পুষ্টিবর্ধনম" মন্ত্র এবং শিবের উপাসনার প্রধান মন্ত্র" ওঁ নমঃ শিবায় " জপ করি। এ সকল মন্ত্রই বেদ থেকেই নেয়া। মৃত্যু প্রত্যেকের জীবনেই নিশ্চিত। গাছের একটি পাকা ফল আম বা পেপে পেকে টশটশে হয়ে নিজেই গাছ থেকে ঝরে পরে। ঠিক সেভাবেই পূর্ণায়ু পেয়ে আমরা যেন আমাদের দেহরূপ প্রদীপকে যাঁর থেকে এসেছি, তাঁর কাছেই সমর্পণ করতে পারি ভগবানের কাছে এমনই আমাদের প্রার্থনা করা উচিত। আমরা কেউ অনন্তকাল বেঁচে থাকতে থাকতে পারব না। মহাকাল রুদ্রের প্রতি সমর্পিত বেদের মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রে ঠিক এ সমর্পণ ভাবটিই সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে। এ্যম্বকং যজামহে সুগন্ধিং পুষ্টিবিদর্দ্ধনম্। উর্বারুকমিব বন্ধনান্ মৃত্যোমুক্ষীয় মামৃতাৎ।। (ঋগ্বেদ সংহিতা: ০৭.৫৯.১২) "অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বা জন্ম, জীবন ও মৃত্যু-এ ত্রয়ীদ্রষ্টা রুদ্ররূপ হে পরমেশ্বর, তোমার বন্দনা করি। তুমি আমাদের বেঁচে থাকার জন্য সুন্দর পরিবেশ ও পুষ্টিকর খাদ্যের দাতা। পাকা উর্বারুক ফলের ন্যায় আমরা যেন পূর্ণায়ু পেয়েই মৃত্যুর বন্ধন হতে মুক্ত হতে পারি। তোমার অমৃতরূপ হতে যেন বঞ্চিত না হই।" নমঃ শম্ভবায় চ ময়োভবায় চ। নমঃ শঙ্করায় চ ময়স্করায় চ। নমঃ শিবায় চ শিবতরায় চ।। (শুক্লযজুর্বেদ সংহিতা: ১৬.৪১) "মুক্তি এবং সংসারসুখদাত। ভগবান শিবকে নমস্কার, লৌকিক ও মোক্ষসুখের কারক শিবকে নমস্কার; যিনি কল্যাণরূপ হয়ে ভক্তজনের কল্যাণ-বিধান করেন সেই ভগবান রুদ্রকে নমস্কার। " বেদের তৈত্তিরীয় আরণ্যকের দশম প্রপাঠকের বাইশ অনুবাকে একা শুধু ভগবান শিব নয়; অম্বিকাপতি, উমাপতিকেও বন্দনা করা হয়েছে। অর্থ্যাৎ ভগবান শিবের সাথে সাথে জগন্মাতা অম্বিকাকেও বন্দনা করা হয়েছে। নমো হিরণ্যবাহবে হিরণ্যবর্ণায় হিরণ্যরূপায় হিরণ্যপতয়ে অম্বিকাপতয় উমাপতয়ে পশুপতয়ে নমো নমঃ।। "অম্বিকাপতি, উমাপতি, পশুপতি, হিরণ্যাদি সর্বনিধির পালক, তেজোময়, হিরণ্যবাহু, হিরণ্যবর্ণ, হিরণ্যরূপ পরমেশ্বর শিবের
শুধুমাত্র বেদেই নয়, মহাভারতের অসংখ্য স্থানে শিবমহিমা এবং স্তোত্র আছে। এর মধ্যে অনুশাসন পর্বের সপ্তদশ অধ্যায়ে বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক বলা ভগবান শ্রীশিবের সহস্র নামস্তোত্র অন্যতম, এ পবিত্র স্তোত্র সনাতন ধর্মাবলম্বী আমাদের নিত্যপাঠ্য। সেই স্তোত্রের শুরুতেই ভগবান শিবের মহিমা সম্পর্কে ঋষি তণ্ডী শ্রীকৃষ্ণকে যা বলছেন, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। "যিনি তেজেরও তেজ, তপস্যারও তপস্যা, শান্তদিগের মধ্যে অতিশান্ত, সকল প্রভারও প্রভা, জিতেন্দ্রিয়দের মধ্যে যিনি জিতেন্দ্রিয়, জ্ঞানীদের মধ্যে যিনি শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী, দেবতাদেরও যিনি দেবতা, ঋষিদের ঋষি, যজ্ঞসমূহের যজ্ঞ, মঙ্গলকারীদের মঙ্গলকারী, রুদ্রগণের রুদ্র, প্রভাবশালীদের প্রভাব, যোগীদের যোগী, সকল কারণের কারণ এবং যাঁর থেকে সমস্তলোক উৎপন্ন হয় আবার যাঁর মধ্যে লয় পায়, সেই সর্বভূতাত্মা, সংহর্তা, অমিততেজা ভগবান মহাদেবের অষ্টোত্তর সহস্রনাম আমার নিকট শুনুন; হে মনুষ্যশ্রেষ্ঠ শ্রীকৃষ্ণ, এ মহাপবিত্র স্তোত্র শ্রবনেই আপনি সকল অভীষ্ট লাভ করবেন।" (শিবসহস্রনামস্তোত্রম: ২৬-৩০) প্রায় দুইহাজার বছর পূর্বে মহাকবি কালিদাস তাঁর জগতনন্দিত মহাকাব্য রঘুবংশের শুরুতে প্রথম শ্লোকেই জগতের আদি মাতা-পিতা পার্বতী এবং পরমেশ্বর শিবের বন্দনা করেছেন অসাধারণ আলঙ্কারিক ব্যঞ্জনায়। তিনি বলেছেন-যেমন শব্দ এবং শব্দ থেকে উৎপন্ন তার অর্থকে আলাদা করা যায় না; ঠিক একইভাবে শিব এবং শক্তিকেও আলাদা করা যায় না। বাগর্থাবিব সম্পৃক্তৌ বাগর্থপ্রতিপত্তয়ে। জগতঃ পিতরৌ বন্দে পার্বতীপরমেশ্বরৌ।। "শব্দ এবং শব্দের অর্থ যেমন করে সম্পৃক্ত; ঠিক একইভাবে সম্পৃক্ত জগতের আদি পিতা-মাতা শিব এবং পার্বতী। বাগর্থ সহ সকল প্রকার বিদ্যা কলার প্রতিপত্তির জন্যে সেই পার্বতী- পরমেশ্বরকেই সদা বন্দনা করি।" মহাকবি কালিদাসের মত ঠিক একই কথা শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব তাঁর কথামৃত গ্রন্থে। কথামৃত গ্রন্থটি শুধু নামেই নয়, সত্যিকার অর্থেই কথামৃত। সেই গ্রন্থে অসংখ্য উদাহরণের মাধ্যমে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব আমাদের অত্যন্ত সাবলীলভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, "ব্রহ্ম এবং তাঁর শক্তি অভেদ। 11 আমাদের ওয়েবসাইট আপনার অভিজ্ঞতা উত্থত "... "... তাই ব্রহ্ম আর শক্তি অভেদ। এককে মানলে, আর একটিকেও মানতে হয়। যেমন অগ্নি আর তার দাহিকা শক্তি; অগ্নি মানলেই দাহিকা শক্তি মানতে হয়, দাহিকা শক্তি ছাড়া অগ্নি ভাবা যায় না।... সূর্যেকে বাদ দিয়ে সূর্যের রশ্মি ভাবা যায় না।" জগতের স্রষ্টা এবং জগতের আধার এক অদ্বিতীয় ব্রহ্ম ও তাঁর অবিচ্ছেদ্য শক্তিকেই আমরা বিভিন্ন নামে অভিহিত করে, বিভিন্ন রূপে তাঁকে উপাসনা করি। তিনিই ব্রহ্ম, তিনিই সেই ব্রহ্মের ক্রিয়াশীল শক্তি, তিনিই পুরুষ এবং তিনিই জগতের আধার প্রকৃতি। সেই এক অদ্বিতীয় পরমেশ্বর যখন জগত সৃষ্টি করেন তখন তিনি ব্রহ্মা নামে অভিহিত হন। সেই ব্রহ্মারই সত্ত্বগুণ সম্পন্না শক্তি হলেন ব্রহ্মাণী। এ ব্রহ্মাণীই সরস্বতী, গায়ত্রী, সাবিত্রী সহ বিভিধ নামে অভিহিতা। সেই অদ্বিতীয় পরমেশ্বরের পালন রূপের নাম বিষ্ণু এবং বিষ্ণুর রজোগুণ সম্ভূতা ক্রিয়াশীল শক্তির নাম বৈষ্ণবী বা লক্ষ্মী। পরমেশ্বরের ধ্বংস বা প্রলয় রূপের নাম শিব বা মহেশ্বর। এ মহেশ্বরের তমোগুণ সম্ভূতা ক্রিয়াশীল শক্তির নাম মাহেশ্বরী বা কালী। অর্থাৎ তিনি এক, কিন্তু রুচির বৈচিত্র্যময়তার জন্যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে তাঁর প্রকাশ অনন্ত। সনাতন ধর্মানুসারে চিন্তার অতীত পরমেশ্বর যে রূপে সৃষ্টি করেন সেই রূপের নাম ব্রহ্মা, যে রূপে জগৎ পালন করেন সেই রূপের নাম বিষ্ণু এবং যে রূপে লয় বা নাশ করেন সেই রূপের নাম শিব বা মহেশ্বর। এ সহজ কথাটিই শ্রীমদ্ভাগবতের প্রথম স্কন্ধের দ্বিতীয় অধ্যায়ে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত আছে। "প্রকৃতির তিনটি গুণ-সত্ত্ব, রজ এবং তম। পরমেশ্বর এক হলেও এই তিনটি গুণের প্রভাবে বিশ্বের সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের জন্যে ব্রহ্মা-বিষ্ণু- মহেশ্বর রূপ ধারণ করেন।" উপাস্য হিসেবে আলাদা আলাদাভাবে উপাসনা করলেও আমরা সনাতন ধর্মাবলম্বীরা মূলত এক ব্রহ্মেরই অনন্ত রূপ-রূপান্তরের উপাসনা করি। তাই বর্তমানের কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কথায় সংশয়াছন্ন না হয়ে আমরা আমাদের পূর্ববর্তী ঋষি-মুনিদের পথেই সাকার-নিরাকারের সমন্বয়েই অধিকারী ভেদে এক পরমেশ্বরের উপাসনা করতে চাই। অনেকে বলেন, সৃষ্টিকর্তা সাকার হতে পারেন না। আমি তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, সৃষ্টিকর্তা যদি সর্বশক্তিমান হন তবে তিনি সব পারেন, আর যদি না পারেন সেটা তার ব্যর্থতা; তখন তিনি আর সর্বশক্তিমান নন। তাইতো ঋগ্বেদ সংহিতায় বলা হয়েছে: একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি, অগ্নিং যমং মাতরিশ্বানমাহুঃ।। আমানের ওয়েবসাইট আপনার অভিজ্ঞতা উত্থত করতে (ঋগ্বেদ: ০১.১৬৪.৪৬) "সেই এক পরমেশ্বরকেই আমরা অগ্নি, যম, মাতরিশ্বান সহ বিভিন্ন নামে অভিহিত করি।" বিভিন্ন নামে এবং রূপে অভিহিত করলেও তিনি বহু নন, তিনি আদতে একজনই। সেই অনন্তরূপে পরিব্যাপ্ত এক ঈশ্বরের করুণায় এ জগত পূর্ণ। 

শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্তী সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। />


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url



 



 

 আপনার প্রতিষ্ঠান এর বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন 01839920911